Tuesday, February 11, 2025
HomeLocalউপকূলজুড়ে নিষিদ্ধ জালের ছড়াছড়ি, সৈকতে ডিম পাড়তে পারছে না মা কচ্ছপ

উপকূলজুড়ে নিষিদ্ধ জালের ছড়াছড়ি, সৈকতে ডিম পাড়তে পারছে না মা কচ্ছপ

কক্সবাজার সৈকতে প্রায়ই মরা মা কচ্ছপ ভেসে আসে

কক্সবাজার সৈকতের নাজিরারটেক উপকূল। আজ বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে একটি মরা কচ্ছপ। কয়েকটি কুকুর কচ্ছপটি নিয়ে টানাটানি করছিল। পরে স্থানীয় জেলেরা কচ্ছপটি বালুচরে পুঁতে ফেলেন। স্থানীয় জেলে আবদুল জলিল (৫৫) ধারণা করছেন, নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে কচ্ছপটির মৃত্যু হয়েছে। ওই কচ্ছপের পেটে ডিম ছিল। কুকুরের দল ডিম খেয়ে ফেলেছে। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় পর বালুতে কচ্ছপটি পুঁতে ফেলা হয়েছে।

এর আগের দিন গতকাল বুধবার সকালে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে সৈকতের কবিতাচত্বর পয়েন্টে ভেসে আসে আরেকটি মা কচ্ছপ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের নেতৃত্বে একটি দল। কচ্ছপটির দৈর্ঘ্য ছিল ২ ফুট ৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ ফুট। ওজন ২৬ কেজি। তবে অলিভ রিডলে প্রজাতির এই স্ত্রী কচ্ছপের পেটে ডিম ছিল বলে দাবি করেন সাঈদ মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বালুচরে ডিম পেরে সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার সময় নিষিদ্ধ বিহিঙ্গি জালে আটকা পড়ে কচ্ছপটির মৃত্যু হতে পারে। কচ্ছপের গলা, বুক ও বাঁ পাশের পাখনায় জখমের দাগ পাওয়া গেছে।

গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে চলতি মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতে অন্তত ৩০টি মরা মা কচ্ছপ ভেসে এসেছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ। পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, মরা ৩০টি কচ্ছপের মধ্যে অন্তত ১৬টি কচ্ছপ কুকুর, গুইসাপ খেয়ে ফেলেছে। অবশিষ্ট কচ্ছপগুলো বালুচরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। একই সময় ডিম পাড়তে আসা দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়া আরও অন্তত ১২টি কচ্ছপকে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব কচ্ছপ গভীর সমুদ্রে ফিরে যেতে পেরেছে কি না সন্দেহ আছে। কারণ, উপকূলজুড়ে নিষিদ্ধ জালের ছড়াছড়ি।

স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা বলেন, উপকূলের ১০০ কিলোমিটারজুড়ে অন্তত এক হাজার নিষিদ্ধ বিহিঙ্গি জাল ও কারেন্ট জাল বসানো থাকে। মাঝেমধ্যে কোস্টগার্ড কিছু জাল জব্দ করলেও পরে আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ জাল বসানো হয়। এতে সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের জালে আটকা পড়ে অসংখ্য মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে।

কচ্ছপের ডিমগুলো সংরক্ষণের কাজ করে বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) কর্মীরা। নেকম কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ূম বলেন, গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে নির্জন সৈকতে ছুটে আসে। কিন্তু সমুদ্রের যত্রতত্র মাছ ধরার জাল ফেলে রাখায় কচ্ছপ উপকূলে ডিম পাড়তে আসতে পারছে না। জালে আটকা পড়ে বিপুলসংখ্যক মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে। জালে আটকা পড়লে অনেক জেলে কচ্ছপকে ছেড়ে না দিয়ে লাঠি দিয়ে পিঠিয়ে হত্যা করে তারপর সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। পরে জোয়ারের পানিতে মরা কচ্ছপ সৈকতে ভেসে আসে।

মা কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে মানসম্পন্ন গবেষণা করা দরকার বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, প্রায়ই জোয়ারের পানিতে মৃত কচ্ছপ ভেসে আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু জনবল–সংকটের কারণে কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানগুলো সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত কত কচ্ছপ মারা গেছে কিংবা মৃত ভেসে এসেছে—এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

তবে নেকমের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালে সমুদ্রসৈকতের বালুচর থেকে ১০ থেকে ১২ হাজার ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। ইদানীং মা কচ্ছপের মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়া এবং ডিম পাড়ার পরিবেশ না থাকায় ডিম সংগ্রহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ২০২২ সালে পুরো সৈকত থেকে নেকম ডিম সংগ্রহ করেছিল প্রায় এক হাজার। চলতি মৌসুমের দেড় মাসে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৭৭১টি ডিম। আগামী মার্চ পর্যন্ত কচ্ছপের ডিম পাড়ার মৌসুম।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বলেন, কচ্ছপের মৃত্যু নিয়ে অতীতে গবেষণা হয়নি। সম্প্রতি সৈকতে ভেসে আসা তিনটি মরা মা কচ্ছপ উদ্ধার করে গবেষণা চালানো হয়েছে। নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়েই কচ্ছপগুলোর মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সরাসরি মানুষের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডেও দিন দিন কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থান নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, জেলেদের মধ্যে কেউ কেউ জালে আটকা পড়া কচ্ছপ পিটিয়ে মেরে সাগরে নিক্ষেপ করেছেন, এমন অভিযোগ তাঁরাও পেয়েছেন। তবে এসব জেলেকে চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ, কক্সবাজার সাগরে সারা দেশের কয়েক হাজার ট্রলার মাছ ধরে। তবে এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করা হয়েছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments