Tuesday, February 11, 2025
HomeLocalকেন্দুয়া বিলে মাছ ও কৃষিতে নীরব বিপ্লব

কেন্দুয়া বিলে মাছ ও কৃষিতে নীরব বিপ্লব

বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লা হাট ও খুলনার রূপসা উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে কেন্দুয়া বিলের অবস্থান সমুদ্র উপকূলের জেলা হলেও বাগেরহাট, খুলনার ভৌগোলিক অবস্থায় কেন্দুয়া বিল এক ব্যতিক্রম। সাধারণত উপকূলীয় জেলাগুলোয় এত বড় বিল বা হাওর চোখে পড়ে কম। তাই কেন্দুয়া বিলে গেলে উপকূলীয় জেলার বৈচিত্র্যের সঙ্গে মিল খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। এ লেখার প্রধান বিষয় হচ্ছে বিলের ঘটে যাওয়া মৎস্য চাষে বিপ্লব আর কৃষিক্ষেত্রে চলমান বিপ্লব নিয়ে।

আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগেও এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ ছিল এ কেন্দুয়ার বিল। কারণ, প্রায় সারা বছরই জলাবদ্ধতা ও ধাপ (জলজ উদ্ভিদ পচে চোরাবালির মতো সৃষ্টি হওয়া) এর কারণে ফসল না হওয়া, পরিকল্পিত মৎস্য চাষ সম্পর্কে কৃষকদের মধ্যে সঠিক ধারণা না থাকায় এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। এখনো প্রবীণ মানুষের মুখে শোনা যায় দুঃখের সেই দিনের কথা। ফসল না হওয়ায় তাদের খাদ্যের একটা বড় উৎস ছিল শাপলা থেকে প্রাপ্ত ঢেপের ভাত ও খই। এই অঞ্চলের লোকের বিকল্প কোনো অর্থ উপার্জনের পথও ছিল না।

বিল অঞ্চলের মানুষের দুঃখ–কষ্টের দিন আজ আর নেই। কোনো গ্রামে দুঃখ-কষ্টের কথাও এখন আর শোনা যায় না। বিলে ঘুরে ও এই এলাকার মৎস্যচাষি এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে বর্তমানে তাদের তেমন কোনো সমস্যার কথা শুনতে পেলাম না। বিলের মধ্যে কিছু খাল পুনঃখনন করা ছাড়াও তাদের আর কোনো দাবিও নেই। সবকিছু মিলিয়ে কেন্দুয়া বিলসংলগ্ন মানুষ এককথায় খুশি। বিলে ঘটে যাওয়া মৎস্য ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্যের পেছনে পরিকল্পিত মৎস্য চাষ, যা এ অঞ্চলে ঘেরে মাছ চাষ নামে বহুল পরিচিত। মৎস্য চাষের সঙ্গে সঙ্গে ঘেরের পাড়ে কৃষিকাজও করা হয়।

অনেক দিন ধরে কেন্দুয়া, কোদালিয়া বিলসহ আশপাশের অন্যান্য বিলে মাছ চাষ ও কৃষিতে ব্যাপক সাফল্যের কথা শুনে আসছিলাম। গত কিছুদিন আগে শীতের এক সকালে কেন্দুয়া বিলে ভ্রমণের সুযোগ ঘটে গেল মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকারি একটি পরিদর্শন দলের সঙ্গে। সফরের উদ্দেশ্য ছিল বিএডিসির তত্ত্বাবধানে নলধা খালের পুনঃখননকাজ পরবর্তী পরিদর্শন, সঙ্গে মৎস্য চাষ ও কৃষিতে সাফল্য দেখতে।

নলধা মন্দিরসংলগ্ন নলধা খালের মুখ থেকে ডিঙিনৌকায় রওনা হলাম কেন্দুয়া বিল পরিদর্শনে। নলধা খাল বেয়ে অপরূপ এক সৌন্দর্যের পরশ নিয়ে। কিছুদূর গিয়ে পড়লাম কালীগঙ্গা নদীতে। নলধা খালটি ভরাট হয়ে মৃত প্রায় হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে বিআরডিবির তত্ত্বাবধানে খালটির পুনঃখনন করা হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মার খাল, রত্নার খাল, চন্দ্রের খাল, শুভর খাল, দাড়িয়া ঘাটিয়াখালসহ বেশ কিছু খাল কেন্দুয়া বিল রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ খালের পুনঃখনন প্রয়োজন।

বিলের মাঝ থেকে কালীগঙ্গা নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদী ফকিরহাট ও মোল্লা হাটকে বিভক্ত করেছে। আর কালীগঙ্গা বেয়ে পশ্চিম দিকে কয়েক কিলোমিটার গেলেই খুলনার রূপসা উপজেলার বিলের অংশ পড়বে। কালীগঙ্গা নদীটি চিত্রা ও ভৈরব নদের সঙ্গে যুক্ত।
কেন্দুয়া বিলের আগের চেহারা এখন আর দেখা যাবে না, কারণ বিল বলতে আমরা সাধারণত বুঝি বাধাহীন বিস্তীর্ণ জলাভূমি। কিন্তু সেই বিল এখন ছোট ছোট অসংখ্য বাঁধ দিয়ে মাছের ঘেরে পরিণত করা হয়েছে। ঘেরে মাছ চাষ ছাড়া ও এখন ১২ মাস কৃষিকাজ হচ্ছে। বিলের অধিকাংশ জমি ব্যক্তিমালিকানায়। অনেকে লিজ নিয়ে ও মৎস্য চাষ করে থাকেন। এক বিঘা জমি লিজ নিতে জমির রকমভেদে ৫ হাজার থেকে ২০-২২ হাজার টাকা লাগে। এখানে লিজ নেওয়া শব্দটি হারির টাকা নেওয়া হিসেবে বলা হয়।

কেন্দুয়া বিল যখন উন্মুক্ত জলাশয় ছিল, তখন প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কই, শিং, মাগুর, সরপুঁটি, রয়না, শোল, গজাল, খলসে ইত্যাদি। উন্মুক্ত জলাশয় এখন ছোট ছোট ঘেরে পরিণত হওয়ায় দেশীয় ওই সব মাছ আর আগের মতো পাওয়া যায় না।

বেশ কিছু বছর আগে থেকে কেন্দুয়া বিলে মৎস্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। এখন প্রচুর পরিমাণ মৎস্য উৎপাদন হচ্ছে। বর্ষার আগে ঘেরে পোনা মাছ ছাড়া হয়। নিবিড় পরিচর্যার পর শীতকালে মাছ ধরে ঘের সেচে ফেলে বা শুকিয়ে ফেলে এবং অধিকাংশ ঘেরে এখন ইরি ধান রোপণ করা হয়। তাই ১২ মাসই ঘেরে হয় মাছ না হয় ধান। যেটা আগে সম্ভব ছিল না। ঘেরে সাধারণত রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাসকার্প, মিনারকার্প চাষ করা হয়। কেন্দুয়া বিলে মাছ চাষে ব্যাপক সফলতার জন্য এলাকাবাসী আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। তবে বর্তমানে মাছের খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে লাভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

কেন্দুয়া বিল, কোদালিয়া বিলসহ আরও কিছু বিলে ঘেরে উৎপাদিত মাছ বিক্রির জন্য খুলনা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে ফকিরহাটের ফলতিতায় দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে বিশাল এক পাইকারি মৎস্যবাজার গড়ে উঠেছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন মাছ কেনেন। প্রতিদিনই বসে মৎস্যবাজার। কয়েক শ আড়ত রয়েছে এ বাজারে। মৎস্যচাষিদের তাই মাছ বিক্রি করতে কোনো বেগ পেতে হয় না।

কেন্দুয়া বিলে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মৎস্যজীবীদের নিরলস পরিশ্রমের পাশাপাশি মৎস্য অধিদপ্তর নানান পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে চলেছে। তবে মাঝেধ্যেই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। তখন মৎস্যচাষিরা ভবিষ্যতের ক্ষতির আশঙ্কায় দিশাহারা হয়ে পড়েন। তাই এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এবং মৎস্য বিভাগের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

একসময় এ বিলে অতিথি পাখির বিপুল সমাগম ঘটত। কিন্তু উন্মুক্ত জলাশয় সংকুচিত হওয়ার ফলে ও চোরা শিকারিদের কারণে আগের মতো পাখি আর দেখা যায় না। কেন্দুয়া বিলে মৎস্য চাষের মতো কৃষিক্ষেত্রে ও নীরব বিপ্লব হচ্ছে। ঘেরের মধ্যে ধান চাষের সঙ্গে সঙ্গে শত শত ঘেরের পাড়ে ১২ মাস কৃষিকাজ হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সবজির পাশাপাশি পেঁপে, তরমুজ ও বাঙ্গিও ব্যাপক চাষ হচ্ছে। বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় আগে বিলে সীমিত আকারে শর্ষের চাষ হলেও এ বছর ব্যাপকভাবে শর্ষের আবাদ হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের নিরলস পরিশ্রম তাদের পরামর্শ ও বিভিন্ন সহায়তা এর অন্যতম কারণ।

ঘেরের পাড়ে সামান্য কিছু নারকেলগাছ, বেশ কিছু কলাগাছও দেখতে পাওয়া যায়। অন্য কোনো ফলদ বা বনজ গাছ না লাগানোর পেছনে যুক্তি হচ্ছে ওই সব গাছের পাতায় ঘেরের পানি দূষিত হয়ে মাছ চাষে বিঘ্ন ঘটায়।

কেন্দুয়া বিলে মৎস্য ও কৃষিতে ঘটে যাওয়া নীরব বিপ্লবকে আরও বেগবান করতে বিলের পানিনিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও নৌকা নিয়ে অবাধ যাতায়াতের জন্য বিলের মধ্যে বেশ কিছু খালের পুনঃখনন প্রয়োজন। আশার কথা, সরকারের বিএডিসির তত্ত্বাবধানে নলধা খালের পুনঃখনন করা হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে আরও সক্রিয় হতে হবে। ঘের কৃষিকে কৃষির মূল ধারায় আনতে হবে। তাদের কার্যক্রম, সহায়তা ও পরামর্শ আরও বৃদ্ধি করতে হবে। পরিশেষে কেন্দুয়া বিলের মানুষের সাফল্য ও ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ছড়িয়ে দিতে হবে সমগ্র দেশে। এই বৈশ্বিক সংকটকালে মানুষকে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

* লেখক: পার্থ দেব সাহা, প্রভাষক, সরকারি ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, ফকিরহাট, বাগেরহাট

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments