Tuesday, February 11, 2025
HomeNationalনদী বাঁচানোর মডেল হোক বালু নদ

নদী বাঁচানোর মডেল হোক বালু নদ

২০১৯ সালে বালু নদের তীরে বহুতল ভবনে উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ইছাপাড়া এলাকায়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দেশের সব নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করা হবে। বাড়ানো হবে নাব্যতা। সুদূরপ্রসারী এ পরিকল্পনার প্রাথমিক উদ্যোগে ঢাকার পূর্ব সীমানা নির্ধারণকারী বালু নদকে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে দখল ও দূষণমুক্ত করে বালু নদে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হবে। এক মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে।
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত ‘ছয় মাসের মধ্যে বালু নদ দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।

তাতে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে আগামী এপ্রিলের মধ্যে নদীটি দখল ও দূষণমুক্ত হবে। নাব্যতাও ফিরে পাবে। অবশ্য তার আগেই চলতি নভেম্বরের মধ্যেই বালুকে স্বরূপে ফিরে পাওয়ার মহাপরিকল্পনা প্রণীত হওয়ার কথা। সেই মহাপরিকল্পনার কতটা আমরা জানতে পারব, এখনই তা বলা মুশকিল। উদ্যোগ কতটুকু অর্জিত হবে, সেটা সময়ই বলবে। তবে বালু নদকে একক বা বিচ্ছিন্ন কোনো জলধারা ভাবলে চলবে না। এ জলধারার সঙ্গে সংযুক্ত ধারাগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। উৎস থেকে শুরু করে পতিত মুখ পর্যন্ত বালু নদের প্রবাহপথের বর্ণনা দিলে বিষয়টি আরও খোলাসা হবে।

আমরা দেখেছি, বর্তমান বালু নদের মূল উৎস বেলাই বিল। সেই বিলের বুকে দ্বীপের মতো গ্রাম। কোথাওবা এক বাড়ি নিয়েই দ্বীপবাড়ি। কাগজের ফুলের মতো সুন্দর কচুরিপানারও দেখা মেলে সেই বিলে। তার ফাঁকে ফাঁকে লাল, সাদা শাপলা। এ বিলের ছোট মাছের বেশ সুনাম। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বিলের পানি এখনো স্বচ্ছ। তাতে আনন্দে সাঁতার কাটে উদোম গায়ের শিশুরা। বাড়ির ঘাটে গেরস্থালি সারে বউ, মেয়েরা। গোটা বিলেই পাখির বিচরণ। বাজ, চিল, বক, মাছরাঙার মেলা। যেহেতু উজানে কাপাসিয়ার কাছে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে সংযোগ গড়া সুতী নদী এখন প্রায় মৃত; তাই শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদের মধ্যবর্তী অববাহিকার সব পানি মূলত বেলাই বিল হয়েই বালুতে নামে।

টঙ্গী শিল্প এলাকার বর্জ্য বয়ে আনা তুরাগের কালো ধারাটাকে দ্রুতই নিজের বুকে মিশতে দেয়নি। পাশে নিয়ে ছুটেছে খানিক। একসময় আর পারেনি। বালুর সাদা বিলীন হয়ে গেছে তুরাগের বিষাক্ত কালোয়।

পুবাইল বাজার পশ্চিমে রেখে বালু যেখানে বেলাই বিলের সঙ্গ ছেড়েছে, সেখানকার পানি এখনো স্বচ্ছই আছে। সেখান থেকে দক্ষিণমুখী প্রবাহ ধরে ভাটিতে এগুলোর পাশাপাশি তিনটি সেতু পাওয়া যাবে দড়িপাড়ার কাছে। আর একটু ভাটিতে ঢাকা বাইপাস সড়ক সেতুর পূর্ব তীরে উলুখোলা—দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষিপণ্যের বাজার। এ বাজারের বর্জ্যও নদীতেই মেশে।

আরও ভাটিতে উত্তর-পশ্চিম থেকে তুরাগ নদ এসে বালুতে মিশেছে। জায়গাটার নাম তেরমুখ। সেখানে, নদী সঙ্গমে লম্বাটে এক দ্বীপে দিব্যি জেঁকে বসেছে ইটের ভাটা। ভাটার পাশ দিয়ে সেতু পেরোনো বালুর ধারাটা কিছু দূর পর্যন্ত সাদা।

টঙ্গী শিল্প এলাকার বর্জ্য বয়ে আনা তুরাগের কালো ধারাটাকে দ্রুতই নিজের বুকে মিশতে দেয়নি। পাশে নিয়ে ছুটেছে খানিক। একসময় আর পারেনি। বালুর সাদা বিলীন হয়ে গেছে তুরাগের বিষাক্ত কালোয়। আরও এগিয়ে ঢাকা জেলার সীমানায় ঢুকেছে বালু। সেখানে পূর্ব পাড়ে পূর্বাচল সিটি, তারপর ঈসাপুরা বাজার। সেখানে নদীর বুকে আরও ইটভাটা। ঈসাপুরা সেতুর নিচে ওয়াটার ট্যাক্সি চলার মতো উচ্চতাও নেই। আরও ভাটিতে বেরাইদ পেরিয়ে পশ্চিম থেকে এসে বালুতে মিশেছে রামপুরা খাল। মিলন মোহনার আগেই ত্রিমোহিনীতে যার সঙ্গে মিশেছে দেবধোলাই। এই দুই খালের মিলিত ধারা হয়ে ঢাকা শহরের বর্জ্য এসে মিশছে বালুতে।

সেখান থেকে আরও ভাটিতে দক্ষিণপাড়া। তারপর বালু নদ যত ভাটিতে এগিয়েছে, অববাহিকায় ততই বেড়েছে হাউজিং কোম্পানির সাইনবোর্ড। ভরাট হয়ে যাওয়ায় বালু থেকে বেরোনো বুড়িগঙ্গামুখী ধোলাই নদের মুখ চিহ্নিত করা এখন মুশকিলই বটে! আর চনপাড়ার পর থেকে শীতলক্ষ্যার বালুর পতিত মুখ পর্যন্ত স্বচ্ছ পানির দেখা মেলাই ভার।

তার মানে, উৎসে দূষিত হয়নি বালু। তার দূষণ শুরু হয়েছে তুরাগ প্রবাহের সঙ্গে মেশার পর থেকে। ভাটিতে রামপুরা খাল, দেবধোলাই ইত্যাদি খাল হয়ে ঢাকা নগরীর দূষিত পানিও বালুতে মিশছে। প্রভাবশালীদের কবজা ছাড়াও বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি ও ইটের ভাটায় শরীর হারিয়েছে বালু।

যার ওপরে কিছু অপরিকল্পিত সেতু নৌ চলাচলের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাজেই বালু নদে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার মানে হলো, খননের পাশাপাশি অপরিকল্পিত সেতু ব্যবস্থাপনারও প্রাসঙ্গিক পরিবর্তন। দখলমুক্ত করার মানে হলো, সব ধরনের দখলদারি ও প্রকল্পের প্রকোপ থেকে মুক্তি। আর দূষণমুক্ত করার মানে হলো, মূল নদী ও তার সঙ্গে সংযুক্ত সব জলধারারই পরিচ্ছন্নতা অর্জন।

টঙ্গী শিল্প এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুরাহা না করে বালুকে দূষণমুক্ত করা যাবে না। একইভাবে বালুর সঙ্গে সংযুক্ত আর সব জলধারারও তালিকা করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সুতী খালের মুখ খুলে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুনঃসংযোগ গড়ে বালুতে স্বচ্ছ পানির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। সবশেষে প্রয়োজন হবে টেকসই বা স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জেনেছি, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বিশেষ এক কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেই কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা, সিটি করপোরেশন এবং জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের অন্তত দেড় ডজন প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা, এমনকি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সম্পূর্ণ দখল ও দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বালু নদকে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে মূলত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে। সেই সুপারিশের ধারাবাহিকতায় সংসদীয় কমিটিতে অগ্রগতি প্রতিবেদনে উপস্থাপন করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

তাতে বলা হয়েছে, দেশের কমবেশি ৭০০ নদ-নদীর প্রায় সব কটিতেই পড়েছে দখলদারদের থাবা। অনেক নদী দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়। এরই মধ্যে ৬৩ হাজার ২৪৯ জন দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বালু নদকে সম্পূর্ণভাবে দখল ও দূষণমুক্ত করে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে তারা মূলত অন্তত একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়।

আমরা এই দৃষ্টান্ত দেখার অপেক্ষায় থাকব। আশা করব, সম্মিলিত উদ্যোগের সফল মডেল হবে বালু নদ। তারপর সেই মডেলের অনুসরণে পর্যায়ক্রমে দেশের সব নদী দখল ও দূষণমুক্ত হবে। ফিরে পাবে নাব্যতা।

জাকারিয়া মণ্ডল ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, গবেষক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments