Tuesday, February 4, 2025
HomeNationalবিপদ বাড়ছেই কর্ণফুলীর

বিপদ বাড়ছেই কর্ণফুলীর

♦ পড়ছে দূষিত বর্জ্য ও প্লাস্টিক পণ্য ♦ কমছে প্রস্থ ও গভীরতা ♦ ঝুঁকিতে সেতুর পিলার ♦ হুমকিতে মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য ♦ গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা

তিনিয়তই ভরাট হচ্ছে। প্রতিদিনই পড়ছে দূষিত বর্জ্য। অবিরতই হচ্ছে দখল। পড়ছে ক্ষতিকর প্লাস্টিক পণ্য। বাড়ছে অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা। ছোট হয়ে আসছে নদীর প্রস্থ। কমছে গভীরতা। হারাচ্ছে নাব্যতা। ধ্বংস হচ্ছে নদীর জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ। নষ্ট হতে চলেছে নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ। এটি দেশের অর্থনীতির ফুসফুস খ্যাত বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদীর চিত্র। দখল, দূষণ আর ভরাটে ত্রাহি অবস্থা এখন নদীটির। প্রশ্ন উঠেছে, কী হবে কর্ণফুলী নদীর? বাঁচবে তো নদীটি?

জানা যায়, কর্ণফুলী নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় অবৈধ স্থাপনার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তালিকা মতে উচ্ছেদের নির্দেশনা দেন আদালত। কিন্তু তিন বছর আগে টানা পাঁচ দিনের অভিযানের পর থমকে আছে উচ্ছেদ। পক্ষান্তরে নদী রক্ষা কমিশনও কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নির্দেশনা দেয়। এর ওপর পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠনগুলো নিয়মিতই কর্ণফুলী নদী রক্ষায় জোরদার আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগেই কাজ হচ্ছে না। এখন নদীর দুই পারের তিন শতাধিক শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক ও গৃহস্থালি বর্জ্য এবং প্লাস্টিক পণ্যের ভাগাড় কর্ণফুলী। পক্ষান্তরে কর্ণফুলী নদীতে ৮৫টি মার্চেন্ট জাহাজ, ৪০৫টি কোস্টার জাহাজ, ২৬৪টি মাছ ধরার ট্রলার, ৯টি টাগ নৌকাসহ সাম্পান, ছোট ছোট নৌকা, বিদেশি জাহাজ ও ট্রলার চলাচল করে। এসব নৌযানের ময়লা, পোড়া তেল সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। এ ছাড়া অসংখ্য নৌযান বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নোঙর করে রাখায় নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা, ডলফিনসহ জলজ প্রাণীদের স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, ‘আমাদের দাবি হলো, আদালতের নির্দেশনা অনুসারে চিহ্নিত অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা। এখন সেটি না করায় প্রতিনিয়তই নানাভাবেই দখল হচ্ছে কর্ণফুলী। এভাবে দখল হতে থাকলে এটি একদিন হারিয়ে যাওয়া নদীর তালিকায় পড়ে যাবে।’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘নগরের আবাসিক ও শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। এটি নদীর জীববৈচিত্র্য এবং মৎস্য সম্পদের জন্য চরম হুমকি। তাই যে কোনো মূল্যে দূষণ বন্ধ করতে হবে।’ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ নিয়ে কাজ চলমান আছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বন্দরের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। শিগগিরই আমরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব। কর্ণফুলী নদী নিয়ে চট্টগ্রামবাসী নতুন কিছু দেখতে পাবে।’প্লাস্টিকবর্জ্যরেভাগাড়কর্ণফুলী : চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য ২৪৯ টন। কিন্তু এসব প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে মধ্যে সংগ্রহ হয় ১০৯ টন এবং অসংগৃহীত থেকে যায় ১৪০ টন। এই অসংগৃহীত প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে অধিকাংশই খাল হয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। এ কারণেই চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, বায়ু ও মাটিদূষণ এবং নদীতে প্লাস্টিক-পলিথিনের স্তর পড়ে যাচ্ছে। অনুকণা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ, মাছসহ বিভিন্ন প্রাণীর দেহে। ২০৫১ সালের মধ্যে নগরে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪২৮ টনে। ‘২৪৯ টন প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যে পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে এসব তথ্য প্রকাশ করেন চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া ও আল আমিন। নগরের ১৫টি ওয়ার্ডে এ গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়।

হারানোর শঙ্কা ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ : কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে কাপ্তাই বাঁধ পর্যন্ত দুই পারে মোট ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়। এর বেশির ভাগই উজানে। এর মধ্যে ৮১টি বিপন্ন প্রজাতি শনাক্ত করা হয়। নদী দখল-দূষণ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে ৮১টি প্রজাতির বিপন্ন উদ্ভিদ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বনাঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নিশ্চিত। একই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের গাছপালাও ব্যাপক হারে ধ্বংস হচ্ছে। নদীর উজানের দিকে পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের বনের দেখা মিললেও ভাটি অঞ্চলে বন উজাড় হয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা ইফেকটিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেইনিয়নের (ইকো) উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেলের নেতৃত্বে পরিচালিত জরিপে এ তথ্য জানা যায়।

ওমর ফারুক রাসেল বলেন, ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১১৩টি একই পরিবারভুক্ত। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ১৪৪ প্রজাতির, গুল্ম ৬৯, লতা ৫৮, বীরুৎ ২৪৪ ও পরজীবী ১৩ প্রজাতির। এ ছাড়া নদীর মাঝখানে অবস্থিত বাকলিয়া চরে ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে নদীর সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাটের পর পর্যন্ত পাওয়া গেছে মোট ১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ। তিনি বলেন, নদীর দুই পাশে প্রায় ৫০ হাজার খোলা শৌচাগার আছে। আছে নগরের বর্জ্য, কারখানার তরল ও সলিড বর্জ্য, শুঁটকি পল্লীর বিষ ও বর্জ্য, কীটনাশক, ৫৩টি শিল্প-কারখানার বর্জ্য, ১৪টি নৌযান মেরামতের জায়গা, বাজার, নালা, খামার ইত্যাদি কর্ণফুলী দূষণের প্রধান কারণ।

ঠায় দাঁড়িয়ে অবৈধ স্থাপনা : আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলীর উভয় তীরের অবৈধ স্থাপনার তালিকা করে জেলা প্রশাসন। তালিকায় ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে এসব উচ্ছেদের নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা মতে, ২০১৯ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ ও ১০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু বাকলিয়া অংশে অভিযান পরিচালিত হয়নি। এরপর থমকে আছে উচ্ছেদ। বাকি স্থাপনাগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিনিয়ত নতুন করে হচ্ছে বেদখল-ভরাট। চাক্তাই ও রাজাখালী এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, এসব এলাকায় প্রতিনিয়ত নতুন করে দখল করা হচ্ছে। নদীর তীরেই আছে একাধিক বহুতল ভবন। নদীর পাড় দখল করে করা হয়েছে বাস রাখার স্থান।

ঝুঁকিতে শাহ আমানত সেতু : মাছবাজারের উজান অংশে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নিচে ২০১৪ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাস্টারপ্ল্যান ফর চিটাগং পোর্ট’ শীর্ষক জরিপে নদীর প্রবহমান ধারা ছিল ৮৮৬ দশমিক ১৬ মিটার। মাছবাজার গড়ে ওঠায় সেই অংশে নদীর বর্তমান প্রবহমান ধারা মাত্র ৪১০ মিটার। শাহ আমানত সেতুর উত্তর পাশে নদীর মাঝ পিলার পর্যন্ত ভরাট হয়ে গেছে। ব্রিজের নিচে অর্ধেকের বেশি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ব্রিজের তিন পিলার অংশে নদীর প্রবল স্রোত হয়। যে কারণে শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ পাশে ধসে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে ঝুঁকিতে পড়ে সেতুর পিলার।

কমছে নদীর প্রস্থ : ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতুর নিচে কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারায় প্রস্থ ছিল ৮৬৬ মিটার। এখন তা ভাটার সময় ৪১০ মিটার ও জোয়ারের সময় ৫১০ মিটার। রাজাখালী খালের মুখে প্রশস্ততা ৪৬১ মিটার, আগে ছিল ৮৯৪ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে এখন প্রশস্ততা ৪৩৬ মিটার, আগে ছিল ৯৩৮ মিটার। ফিরিঙ্গিবাজার মোড়ে নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার, বন্দর কর্তৃপক্ষ খননের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। শাহ আমানত সেতুর উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা মাছবাজার, বরফকল, অবৈধ দখল ও ভেড়া মার্কেটের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রবহমান ধারা কমে দাঁড়ায় ৪৬১ মিটারে। কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলের কারণে প্রশস্ততা কমছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments