Tuesday, February 11, 2025
HomeGlobalসাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ই তিস্তা সংকটের আভাস ছিল

সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ই তিস্তা সংকটের আভাস ছিল

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ভূরাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু  তিস্তা সংকট, যার অংশীদার হয়ে উঠেছে প্রতাপশালী চীনও। উজান ও ভাটির দুই দেশের মধ্যে নদীটির পানিপ্রবাহ যে এক পর্যায়ে বড় ইস্যু হয়ে উঠতে যাচ্ছে, তার আভাস পাওয়া গিয়েছিল দেশভাগের আগেই। সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বাধীন বাউন্ডারি কমিশনের নথিপত্রেও (পার্টিশন পেপার্স নামেও পরিচিত) এর বিবরণ পাওয়া যায়।  

সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে সিকিম রাজ্য ও অবিভক্ত বাংলার ওপর ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকায় নদীটির আন্তসীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও হিস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়েনি কারোরই। কিন্তু দেশভাগের সময়েই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তিস্তার পানিপ্রবাহ ভবিষ্যতে একটি বিরোধপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠতে যাচ্ছে। ওই সময়ে সিকিমের বাইরে তিস্তার পুরো অববাহিকা অঞ্চলকেই পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতারা। এ কারণে সে সময় জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলা পূর্ব বাংলায় অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছিলেন তারা।

তাদের যুক্তি ছিল, এর ফলে তিস্তার মধ্যম ও নিম্ন অববাহিকার পুরোটাই এক প্রশাসনের অধীনে থাকবে। ফলে ভবিষ্যতে নদীটি ঘিরে কোনো বাঁধ বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হলে তা অববাহিকা অঞ্চলের সবার স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রেখেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। ওই সময় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা এর তীব্র বিরোধিতা করে। অন্যদিকে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিংয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধিক্য থাকায় জেলা দুটি চলে যায় ভারতের অধীনে। সীমান্তের দুই পারেই অববাহিকার জনজীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ নদী হওয়ার কারণে তিস্তা নিয়ে ওই সময়ে যে বিরোধের আভাস দেখা দিয়েছিল, সেটিই এখন আঞ্চলিক ভূরাজনীতির অনেক বড় একটি ইস্যু হয়ে উঠেছে। 

শুধু আঞ্চলিক ভূরাজনীতি নয়, অববাহিকার দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও অনেক বড় একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে তিস্তা। বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস তিস্তাপারে। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় রাজনীতিতেও নদীর পানিপ্রবাহের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে ৪১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটিতে বাংলাদেশের অংশ ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশে নদীটির অববাহিকা অঞ্চল রংপুর বিভাগকে বলা হয় দেশের দরিদ্রতম বিভাগ। এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার উন্নয়নে নদীটির সুযোগ-সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না কোনোভাবেই। এজন্য নদীর উজানে বিশেষ করে সিকিমে একের পর এক বাঁধ দেয়াকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে বারবার অভিযোগ তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। 

এখন পর্যন্ত তিস্তায় শুধু সিকিম অংশেই বড় আকারের বাঁধ নির্মিত হয়েছে আটটি। এসব বাঁধের কারণে সিকিমের পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতে আসতে আসতেই শীর্ণ হয়ে পড়ছে তিস্তা। এর মধ্যেই সিকিমে আরো বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। 

এভাবে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে নদীটির অববাহিকা অঞ্চল রংপুর বিভাগের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ বেড়েছে মারাত্মকভাবে। খরার মৌসুমে নদীটির পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে ভয়াবহ আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষি ও মত্স্য আহরণ কার্যক্রম। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলোর ফটক খুলে দিয়ে পানির অতিরিক্ত প্রবাহ ছেড়ে দেয়া হয় ভাটির দিকে। এ কারণে প্রতি বছরই বাংলাদেশে তিস্তা অববাহিকায় মারাত্মক বন্যা দেখা দেয়, যার ভুক্তভোগী হয় রংপুর অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষেরাই। 

বৃষ্টি ও পাহাড়ি বরফ গলা জলনির্ভর নদী তিস্তায় পানির প্রবাহ সারা বছর সমান থাকে না। নদীটির মোট পানিপ্রবাহের ৯০ শতাংশই হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে। বাকি ১০ শতাংশ প্রবাহিত হয় বছরের অন্য আট মাসে। জলপ্রবাহ কমে গিয়ে এ সময়ে শীর্ণ হয়ে ওঠে তিস্তা। এমনকি খরা মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে পানির গড় প্রবাহ সেকেন্ডে ১৪ ঘনমিটারে নেমে আসার নজিরও রয়েছে।

শুরু থেকেই তিস্তার পানিপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা দাবি করে এসেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে অনেকবার আলোচনায় বসলেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি সই করতে পারেনি বাংলাদেশ ও ভারত। নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হলেও এখন পর্যন্ত এটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পরই ভারত ও তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আন্তসীমান্ত নদী নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তিস্তার উচ্চ অববাহিকা অঞ্চল সিকিম তখনো পুরোপুরি অধিকার করে নেয়নি ভারত। ওই সময়ে সিকিমের পরিচিতি ছিল মূলত নয়াদিল্লির আশ্রিত রাজ্য হিসেবে। ৫০ ও ৬০-এর দশকে নদীটিতে বাঁধ নির্মাণ ও পানি ভাগাভাগি নিয়ে বেশ কয়েকবার পূর্ব বাংলা ও ভারতীয় প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা হয়। তত্কালীন পাকিস্তান সরকার ও ভারতের মধ্যে ওই সময়ে আন্তসীমান্ত নদী নিয়ে দরকষাকষির কেন্দ্রে ছিল গঙ্গা (পদ্মা) ও সিন্ধু নদী। ফলে তিস্তা নিয়ে আলোচনায় খুব একটা জোর দেয়া হয়নি। সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ১৯৬০ সালে চুক্তি হওয়ার পর গঙ্গার পানিবণ্টন দুই সরকারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। কিছু আলোচনা হতে থাকে তিস্তা নিয়েও। ওই সময়ে তিস্তার পূর্ব বাংলা অংশে একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, যার বিরোধিতা করছিল ভারত। নিজ দেশের সীমানায় সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অন্য কোনো আন্তসীমান্ত নদীতে এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের অনুরোধ জানায় দেশটি। যদিও দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরবঙ্গের বাস্তবতা বিবেচনায় এ অনুরোধ মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। যদিও স্বাধীনতার পরও ১৯৯০ সালের আগে এ বাঁধের (ডালিয়া) নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা-তিস্তা ও অন্য ৫২টি আন্তসীমান্ত নদী নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি)। আন্তসীমান্ত নদীগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উভয় দেশের জনসাধারণের স্বার্থরক্ষাকে উদ্দেশ্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হলেও দীর্ঘ সময় ধরে কমিশনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল শুধু গঙ্গার পানি ব্যবস্থাপনাতেই। 

১৯৮৩ সালে দুই দেশ নদীটির পানিবণ্টন নিয়ে জেআরসির ২৫তম বৈঠকে এক অ্যাডহক চুক্তিতে সই হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, তিস্তার মোট প্রবাহের বাংলাদেশ ও ভারতের অধিকার থাকবে যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৯ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ থাকবে অবণ্টিত, যার ব্যবহার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে। এর পরের ১৪ বছর এ অ্যাডহক চুক্তিকে আনুষ্ঠানিক চুক্তিকে পরিণত করার বিষয়ে কোনো ধরনেরই অগ্রগতি দেখা যায়নি।

১৯৯৭ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে গঠিত যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০০০ সালে প্রথম তিস্তা চুক্তির খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাদেশ। এরপর দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজমান থাকে। এরই মধ্যে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে পানিসম্পদ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বেইজিংয়ে একটি বৈঠক বসে। দুই দেশের মধ্যে সে সময় ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সম্পর্কে একটি সমঝোতাও সই হয়। দৃশ্যপটে চীনের আকস্মিক আবির্ভাবে শঙ্কিত হয়ে ওঠে নয়াদিল্লি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আরো দুটি জেআরসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যেই ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশের হিস্যা ও নদীর প্রতিবেশ সুরক্ষা বাবদ গজলডোবা বাঁধে প্রাপ্ত পানির ২৫ শতাংশ ছাড়তে পারবে কলকাতা। এর পর থেকেই তিস্তা সংকট আরো প্রকট হয়ে ওঠে। 

বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তির চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী, মোট পানিপ্রবাহের ৪৮ শতাংশ বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত রাখা হয়। ২০১১ সালে তত্কালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে চুক্তিটি সই হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির বিষয়টি এক ধরনের অচলাবস্থাতেই রয়েছে।

এর মধ্যেই বর্তমানে আবারো দৃশ্যপটে চলে এসেছে চীন। সম্প্রতি বাংলাদেশে তিস্তায় নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি, যা দিল্লিকে দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

প্রসঙ্গত, দুই দেশের ৫৪টি আন্তসীমান্ত নদীগুলোর মধ্যে তিস্তা চতুর্থ বৃহত্তম। ভারতে সিকিমের েসা লামো হ্রদে উত্পত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নদীটি। নীলফামারীর ডিমলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা হয়ে আবার কুড়িগ্রামের চিলমারীর কাছাকাছি এসে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে নদীটি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments