
পশ্চিমের আকাশে গোল সূর্যটা লাল হয়ে গেছে। ধীরে মাঘের কুয়াশা নামছে। এর মধ্যে হাওরপাড়ের একটি বাড়ির গাছে গাছে তখন সাদা রঙের ছোপ বাড়তে শুরু করেছে। বক পাখির দল রাত কাটাতে গাছে গাছে আশ্রয় নিচ্ছে। বক পাখির সঙ্গে অন্য দেশীয় পাখিরও কিচিরমিচির বেড়েছে। পুরো বাড়িটিতে তখন তৈরি হয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির বুনো মেজাজ।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের কাউয়াদীঘি হাওরপাড়ের বিরইমাবাদ গ্রামের হোসনে আরা বেগমের বাড়ির দৃশ্য এটি। বেশ কয়েক বছর ধরে বাড়িটি বক ও অন্যান্য দেশীয় পাখির জন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। কাউয়াদীঘি হাওরের দিকে যাওয়ার পথেই বিরইমাবাদ গ্রাম।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে দেখা যায়, ওই বাড়ির গাছে গাছে সাদা রঙের পাখির মেলা বসেছে। হাওরঘেঁষে বাড়িটির অবস্থান। বাড়ির উত্তর সীমানা ছুঁয়েই হাওরের শুরু। উঁচু পাকা দেয়ালঘেরা বাড়ির ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই গাছে গাছে শুধু পাখিরই দেখা মেলে। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, জারুল, বাঁশঝাড়—বাড়ির সব কটি গাছেই পাখিরা সংসার পেতেছে। প্রতিটি গাছের নিচের ঘাসে পাখির বিষ্ঠার দাগের ছড়াছড়ি।
বাড়ির উঠানে চেয়ার পেতে একাই বসেছিলেন গৃহিণী হোসনে আরা বেগম। মুগ্ধ চোখে পাখিদের চঞ্চলতা দেখছিলেন তিনি। পাখি দেখেই তাঁর বিকেল কাটে। হোসনে আরা বলেন, এখানে বকের সংখ্যাই বেশি। কয়েকটা পানকৌড়ি আর শামুকখোল আছে। মাঝেমধ্যে ধনেশ্বর বেড়াতে আসে। সাদা বকের ভিড়ে অন্যগুলোকে আলাদা করাই কঠিন।
বিকেল হলেই এই পাখি ছোট ছোট দলে উড়ে আসতে থাকে এই বাড়িতে। তখন সেখানে পাখিদের আগমনে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। গতকাল বিকেলেও সেই দৃশ্য দেখা গেল। বকের দল ফিরে আসার পর সেই উৎসবে শামিল হলো দেশীয় অন্য পাখিরাও। শালিক, দোয়েল, ঘুঘুসহ হাজারো পাখি কিচিরমিচির করে বাড়িটিকে রীতিমতো উচ্ছ্বল করে তুলেছে। তবে গাছে বসেই পাখিরা স্থির থাকছে না। নেই। হঠাৎ করেই দুই–এক পাখি উড়াল দিচ্ছে। অন্যরাও তাদের সঙ্গী হলো। পাখির ঝাঁক আকাশে তখন মালার মতো চিত্র ফুটিয়ে তুলল। কিছু সময় পর আবার ফিরে এসে গাছে গাছে বসে পড়ল।
ওই বাড়ির লোকজন জানালেন, প্রায় ১০ বছর ধরে তাদের বাড়িতে এ রকম পাখি আসছে। অগ্রহায়ণ মাস থেকে বক পাখির আসা শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। পৌষ মাসে সেই সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ফাল্গুন মাসে পানকৌড়ির সংখ্যা বেড়ে যায়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস পর্যন্ত পাখি থাকে। পানকৌড়ি বাচ্চা ফোটায়। বক বাচ্চা না ফুটিয়েই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আর শালিক-ঘুঘু তো আছেই।
এখন প্রতিদিন ভোরে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে এই বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙছে। কিছুটা বেলা হলেই পাখিরা দলে দলে বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন দিকে উড়ে যেতে থাকে। দুপুরের দিকে গাছগুলো অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। বিকেল হলেই আবার ফেরার পালা। সন্ধ্যার অন্ধকার পর্যন্ত পাখিদের ফিরে আসার পর্ব চলতে থাকে। এ সশয় পাখির ডাকাডাকিতে বাড়িটি আরণ্যক হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকার নামলেই আবার সব চুপ হয়ে যায়। কোনোকিছু আক্রমণ না করলে বা কোনো বিপদ আঁচ না করলে পাখিরা আর রাতে ডাকে না।
হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘পাখির বিষ্ঠার গন্ধ ছাড়া আর আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমরা কাউকে ডিস্টার্ব করতে দিই না। পাখি আমাদের ভালোই লাগে। আমার ছেলে বিদেশ থাকে। সে–ও বলে, “পাখির যেন কোনো সমস্যা না হয় দেখো”। বিকেলের সময়টা তারারে (পাখিদের) দেখেই কাটে। উঠানে বসে থাকি। কেউ ঢিল-টিল মারে কি না দেখি। প্রতিদিন অনেক মানুষ পাখি দেখতে আসে।’
হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ প্রায়ই ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই বিকেলে এদিকে আসি। সন্ধ্যা হলেই পাখিতে ভরে ওঠে বাড়িটি। বাড়ির লোকজন তাদের বিরক্ত করেন না। যে কারণে প্রচুর পাখি বাড়িতে। খুবই সুন্দর।’